জেনে নিন : রাসূল (স:) নুরের তৈরি নাকি মাটির তৈরী ?

আমাদের সমাজে বহু সময় ধরে একটি বিতর্ক দেখা যায় যে রাসূল (স:) নুরের তৈরি নাকি মাটির তৈরী। এই বিষয়টি নিয়ে এক এক পহ্মের এক এক বক্তব্য দেখা যায়। কেউ রাসূল (স:) কে মাটির তৈরী বলতে আগ্রহী আবার কেউ নুরের তৈরি বলতে চান।

তবে এই প্রশ্নটি আমাদের সমাজ জীবনে কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। তার পরেও আমরা এই প্রশ্নটির উত্তর ইনশাল্লাহ খোজার চেষ্টা করবো।

রাসূল (স:) নুরের তৈরি  এর পহ্মে যে সকল দলিল দেয়া হয় তা প্রথমে বিশ্লেষণ করা যাক।

1 - یٰۤاَہۡلَ الۡکِتٰبِ قَدۡ جَآءَکُمۡ  رَسُوۡلُنَا یُبَیِّنُ لَکُمۡ کَثِیۡرًا مِّمَّا کُنۡتُمۡ تُخۡفُوۡنَ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ یَعۡفُوۡا عَنۡ کَثِیۡرٍ ۬ؕ قَدۡ جَآءَکُمۡ  مِّنَ اللّٰہِ  نُوۡرٌ وَّ کِتٰبٌ مُّبِیۡنٌ ﴿ۙ۱۵﴾
ইয়াআহলাল কিতা-বি কাদ জাআকুম রাছূলুনা-ইউবাইয়িনুলাকুম কাছীরাম মিম্মাকুনতুম তুখফূনা মিনাল কিতা-বি ওয়া ইয়া‘ফূ‘আন কাছীরিন  কাদ জাআকুম মিনাল্লাহি নূরুওঁ ওয়া কিতা-বুম মুবীন।
হে আহলে কিতাব! তোমাদের কাছে আমার রাসূল এসেছে, তোমরা কিতাবের যে সব বিষয় গোপন কর তন্মধ্য হতে বহু বিষয় সে তোমাদের সামনে পরিস্কারভাবে ব্যক্ত করে, আর বহু বিষয় (প্রকাশ করা) বর্জন করে, তোমাদের কাছে আল্লাহর নিকট থেকে এক আলোকময় বস্ত্ত এসেছে এবং তা একটি স্পষ্ট কিতাব (কুরআন)।
(সূরা মায়িদাহ -15)

আয়াতের তাফসীর:

یٰۤاَہۡلَ الۡکِتٰبِ قَدۡ جَآءَکُمۡ  رَسُوۡلُنَا یُبَیِّنُ لَکُمۡ کَثِیۡرًا مِّمَّا کُنۡتُمۡ تُخۡفُوۡنَ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ یَعۡفُوۡا عَنۡ کَثِیۡرٍ ۬ؕ قَدۡ جَآءَکُمۡ  مِّنَ اللّٰہِ  نُوۡرٌ وَّ کِتٰبٌ مُّبِیۡنٌ ﴿ۙ۱۵﴾
হে ঐশীগ্রন্থধারিগণ! আমার রসূল তোমাদের নিকট এসেছে, তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে, সে তার অনেক অংশ তোমাদের নিকট প্রকাশ করে[১] এবং অনেক কিছু (প্রকাশ না করে) উপেক্ষা করে থাকে। অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর নিকট হতে জ্যোতি ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে।[২] [১] অর্থাৎ, তারা তাওরাত ও ইঞ্জীলের মধ্যে যে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করেছে, রসূল (সাঃ) তা উদঘাটন করেছেন এবং যা তারা গোপন করেছিল, তা তিনি প্রকাশ করে দিয়েছেন। যেমন, বিবাহিত ব্যভিচারীকে পাথর ছুঁড়ে মারার শাস্তিকে তারা গোপন করেছিল; যার বিস্তারিত বিবরণ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। [২] (نُورٌ وَّكِتَابٌ مُبِين) এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা 'নূর ও কিতাবুন মুবীন' (জ্যোতি ও সুস্পষ্ট গ্রন্থ) একই সাথে উল্লেখ করেছেন এবং এই দুইয়েরই উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরআন কারীম। কেননা এই দুইয়ের মধ্যে وَ সংযোজক অব্যয়টি পাশাপাশি দুই বিশেষ্যের ভিন্নতা বুঝাতে ব্যবহূত হয়নি; বরং অর্থের ভিন্নতা বুঝাতে ব্যবহূত হয়েছে। এই অব্যয়টি আসলে ব্যাখ্যাকারী সংযোজক অব্যয়। যার স্পষ্ট প্রমাণ কুরআনের পরবর্তী আয়াত, যেখানে বলা হচ্ছে يَهدِي بِهِ الله অর্থাৎ তার দ্বারা আল্লাহ হিদায়াত করেন বা সুপথ দেখান। যদি نور ও كتاب আলাদা আলাদা জিনিস হত, তাহলে কুরআনের এই বাক্যটি এইরূপ হত, يَهدِي بِهِمَا الله অর্থাৎ, সর্বনামটি একবচন না হয়ে দ্বিবচন হত (ه) একবচন না হয়ে هما দ্বিবচন হত এবং অনুবাদ 'এ দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন' না হয়ে) 'উভয় দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন' হত। কুরআনের এই বাক্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ হয়ে গেল যে, 'নূর' ও 'কিতাবে মুবীন' উভয় থেকে উদ্দেশ্য 'কুরআন কারীম'। এ নয় যে, 'নূর' থেকে উদ্দেশ্য মুহাম্মাদ (সাঃ) আর 'কিতাবে মুবীন' থেকে উদ্দেশ্য কুরআন মাজীদ; যেমনটি বিদআত পন্থীদের ধারণা; যারা এই আকীদায় বিশ্বাসী যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর নূরের অংশ বিশেষ এবং যারা অস্বীকার করে যে, তিনি একজন মানুষ। 
(অথচ 'নূর' বলতে যে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে, তার প্রমাণ রয়েছে সূরা তাগাবুনের ৬৪:৮ নং আয়াতে। সেখানে মহান আল্লাহ বলেন, {فَآمِنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَالنُّورِ الَّذِي أَنزَلْنَا} অর্থাৎ, সুতরাং তোমরা ঈমান আনয়ন কর আল্লাহর প্রতি, তাঁর রসূলের প্রতি এবং সেই 'নূর' বা জ্যোতির প্রতি, যা আমি অবতীর্ণ করেছি।) 
অনুরূপ এই মনগড়া আকীদাকে সাব্যস্ত করার উদ্দেশ্যে তারা একটি হাদীসও বর্ণনা করে থাকে, "আল্লাহ সর্বপ্রথম নবী (সাঃ)-এর নূরকে সৃষ্টি করেন, তারপর তাঁর নূর থেকে সারা জগৎ সৃষ্টি করেন।" অথচ নির্ভরযোগ্য কোন হাদীসগ্রন্থে এই হাদীসটির উল্লেখ নেই। উপরন্তু এই হাদীসটি ঐ সহীহ হাদীসের পরিপন্থী, যাতে আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, إن أول ماخلق الله القلم অর্থাৎ, সর্বপ্রথম আল্লাহ যা সৃষ্টি করেন, তা হল কলম। (তিরমিযী ও আবু দাউদ) 
(এ যুগের শ্রেষ্ঠ) মুহাদ্দিস আল্লামা আলবানী (রঃ) বলেন, হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ এবং এটি সেই প্রসিদ্ধ হাদীস বাতিল হওয়ার প্রকাশ্য প্রমাণ, যাতে বলা হয়েছে, "আল্লাহ সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূরকে সৃষ্টি করেছেন হে জাবের!" (হাদীসটি বাতিল। দেখুনঃ তা'লীক্বাতে মিশকাত ১/৩৪)


এখন দেখা যাচ্ছে এখানে নূর এর কথা বলা হয়েছে। এই নূরের তাফসীর হচ্ছে পবিত্র কোরআন। অর্থাৎ আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন বলেছেন তিনি কোরআন পাঠিয়েছেন যা সুস্পষ্ট কিতাব।

ধরুন উদাহরণ স্বরূপ 'সে হচ্ছে রাকিব এবং সে ছাত্র' । এতে বুঝা যায় রাকিব এর বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। তেমনি আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন এক আয়াতে তিনি কোরআন এর কথা বলেছেন 

চরুন আরো কিছু আয়াত দেখি :

1- قُلۡ اِنَّمَاۤ  اَنَا بَشَرٌ  مِّثۡلُکُمۡ  یُوۡحٰۤی  اِلَیَّ اَنَّمَاۤ  اِلٰـہُکُمۡ  اِلٰہٌ  وَّاحِدٌ ۚ فَمَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ رَبِّہٖ فَلۡیَعۡمَلۡ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ  رَبِّہٖۤ  اَحَدًا ﴿۱۱۰﴾٪
কুল ইন্নামাআনা-বাশারুম মিছলুকুম ইউহাইলাইইয়া আন্নামাইলা-হুকুম ইলা-হুওঁ ওয়া-হিদুন ফামান কা-না ইয়ারজূলিকাআ রাব্বিহী ফালইয়া‘মাল ‘আমালান সালিহাওঁ ওয়ালা-ইউশরিক বি‘ইবা-দাতি রাব্বিহীআহাদা- 
বলঃ আমিতো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহ একমাত্র ইলাহ। সুতরাং যে তার রবের সাথে সাক্ষাত কামনা করে সে যেন সৎ কাজ করে এবং তার রবের ইবাদাতে কেহকেও শরীক না করে।
(সূরা কাহফ -110)

2 - اَوۡ  یَکُوۡنَ لَکَ بَیۡتٌ مِّنۡ زُخۡرُفٍ اَوۡ تَرۡقٰی فِی السَّمَآءِ ؕ وَ لَنۡ نُّؤۡمِنَ لِرُقِیِّکَ حَتّٰی تُنَزِّلَ عَلَیۡنَا کِتٰبًا نَّقۡرَؤُہٗ ؕ قُلۡ سُبۡحَانَ رَبِّیۡ  ہَلۡ کُنۡتُ  اِلَّا بَشَرًا رَّسُوۡلًا ﴿٪۹۳﴾
আও ইয়াকূনা লাকা বাইতুম মিন ঝুখরুফিন আও তারকা-ফিছছামাই ওয়ালান নু’মিনা লিরুকিইইকা হাত্তা-তুনাঝঝিলা ‘আলাইনা-কিতা-বান নাকরাউহূ কুল ছুবহা-না রাববী হাল কুনতুইল্লা-বাশারার রাছূলা-।
অথবা তোমার একটি স্বর্ণ নির্মিত গৃহ হবে, অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করবে, কিন্তু তোমার আকাশে আরোহণ আমরা তখনও বিশ্বাস করবনা যতক্ষণ না তুমি আমাদের প্রতি এক কিতাব অবতীর্ণ করবে যা আমরা পাঠ করব। বলঃ পবিত্র আমার মহান রাব্ব! আমিতো শুধু একজন মানুষ, একজন রাসূল।
(সূরা বনি ইসরাইল - 93)

এই সম্পর্কে হাদিসে উল্লিখিত এই যে  :

1- আলক্বামা (রহ:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন: একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামাযে ভুল হয়ে গেল। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম! নামাযে কি নতুন কোন বিষয় ঘটেছে? নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: কী হয়েছে? সাহাবায়ে কিরাম বললেন: আপনি এভাবে এভাবে নামায পড়লেন! তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম পা মুড়িয়ে ক্বিবলামুখী হলেন এবং দুই সিজদা দিলেন। তারপর সালাম ফেরালেন। অতপর যখন আমাদের দিকে মুখ করে বসলেন, তখন বললেন, যদি নামাযে কোন নতুন বিষয় ঘটে, তাহলে আমি তোমাদেরকে সে বিষয়ে অবহিত করবো। কিন্তু আমিতো তোমাদের মতই একজন মানুষ । তোমরা যেমন ভুলে যাও, আমিও ভুলে যাই। সুতরাং আমি যদি (কোন কিছু) ভুলে যাই, তাহলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিও। (সহীহ বুখারী - ৪০১; সহীহ মুসলিম - ৫৭২)

অতএব রাসূল (স:) নুরের তৈরি নয়। তিনি আমাদের মতই মাটির মানুষ ।

আশাকরি বুঝতে পেরেছেন ।

শেয়ার করে অন্যদের জানাতে ভুলবেন না।